মহানবি (সা.) এর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হাদিস

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইসলাম শিক্ষা - Islamic Study - কুরআন ও হাদিস শিক্ষা | | NCTB BOOK
323
323

মহানবি (সা.)-এর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হাদিস

হাদিস-১: (সন্তানকে সালাতের নির্দেশ সম্পর্কিত হাদিস)

مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلُوةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِيْنَ

অর্থ: তোমরা তোমাদের সন্তানদের সালাতের জন্য নির্দেশ দাও, যখন তারা সাত বছরে পৌঁছে। (আবু দাউদ)

ব্যাখ্যা 

এই হাদিসে সন্তানকে দ্বীন শিখানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিশুর জীবনের গতিপথ নির্ধারণে পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সন্তানকে আখিরাতের প্রস্তুতির শিক্ষা দেওয়া মাতাপিতার ওপর কর্তব্য। তাকে জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি দ্বীনী শিক্ষা দিতে হবে। আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দিতে হবে। তাছাড়া তাকে যদি ভালো কাজ শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে সে দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্যবান হবে। আর যদি তাকে মন্দ কাজে অভ্যস্ত করা হয়। অথবা অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করা হয়। তাহলে সে হতভাগ্য ও ধ্বংস হবে।

ইমানের পর সালাতই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। পিতা-মাতার দায়িত্ব হলো শৈশব থেকে সন্তানকে সালাতে অভ্যস্ত করা। তাহলে সে ভবিষ্যতে সালাতের প্রতি যত্নবান হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সালাতকে মু'মিন ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্যকারী আখ্যা দিয়েছেন। শুধু সালাত আদায় নয়, বরং পরিবার ও সমাজে সালাত প্রতিষ্ঠার নির্দেশও দিয়েছে ইসলাম।

মা-বাবা ও অভিভাবককেও সালাতের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। কারণ, শিশুরা বড়দের দেখে শেখে। মা- বাবা সালাত আদায়ের সময় সন্তানকে পাশে রাখবে। যেন সন্তান তাদের অনুকরণ করতে পারে। শুধু উপদেশ বা ধারণা দেওয়াই যথেষ্ট নয়। মোটামুটি বুঝ-জ্ঞান হলে সন্তানকে মসজিদে নিতে হবে। সাত বছর বয়স হলে সন্তানকে হাতে-কলমে সালাত শিক্ষা দিতে হবে। সন্তানের সামনে সালাতের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। সালাত  না পড়ার কুফল ও শাস্তি বর্ণনা করতে হবে। সালাত সম্পর্কিত ঘটনা শোনাতে হবে। তাহলে শিশুরা সালাতে উৎসাহী হবে।

সন্তান ঠিকমতো সালাত পড়ছে কি না, সেদিকেও মা-বাবাকে লক্ষ রাখতে হবে। সালাতে অলসতা করলে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সন্তান যেন সালাতের প্রতি যত্নবান হয়, সেজন্য মা-বাবা দোয়াও করবে। ১০ বছর বয়স পর্যন্ত সন্তানকে উৎসাহের মাধ্যমে সালাতে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করবে। ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সন্তানকে সালাতের নির্দেশ দেবে। এরপরও তারা সালাতে অবহেলা করলে প্রয়োজনে শাসন করবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সন্তানদের নেককার ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার তাওফিক দান করুন।

 

শিক্ষা

 ১. মাতা-পিতার দায়িত্ব হলো সন্তানদের দ্বীনী শিক্ষাসহ আদব ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া। 

২. মাতা-পিতা নিজে সালাতের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া। 

৩. সন্তানকে ৭ বছর থেকে সালাতে অভ্যস্ত করা। শিশুকাল থেকে সালাতে অভ্যস্ত না হলে পরে সালাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। 

৪. ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার পরও সালাতে অবহেলা করলে শাসন করা।

হাদিস-২ (বৃক্ষরোপণ সম্পর্কিত হাদিস)

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا فَيَأْكُلُ مِنْهُ إِنْسَانٌ أَوْ طَيْرٌ أَوْ بَهِيمَةٌ إِلَّا كَانَتْ لَهُ صَدَقَةٌ

অর্থ: কোনো মুসলমান যদি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা ফসল আবাদ করে, এরপর তা থেকে মানুষ অথবা পাখি অথবা চতুষ্পদ প্রাণি খায়, তবে তা তার জন্য সাদকাহ হিসেবে গণ্য হবে। (তিরমিযি)

ব্যাখ্যা 

এ হাদিসে মহানবি (সা.) বৃক্ষরোপণ ও ফসল উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মানুষের জীবনযাত্রায় সবুজ বৃক্ষ ও ফসলের অবদান অপরিসীম। এর দ্বারা মানুষ বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান প্রয়োজন। বৃক্ষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের সে প্রয়োজন পূরণ করে। বৃক্ষ থেকে আমরা খাদ্য, ওষুধ, পোশাক, কাঠ, ফল ইত্যাদি লাভ করি। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায়ও বৃক্ষের ভূমিকা  গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, অক্সিজেনের সরবরাহ বৃদ্ধি, জলবায়ুর উষ্ণতা রোধ, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি রোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য।

আবার বৃক্ষ আমাদের আর্থিক সচ্ছলতাও প্রদান করে। খাদ্য থেকে শুরু করে ওষুধ পর্যন্ত সবকিছুই মানুষ বৃক্ষরোপণ ও চাষাবাদের মাধ্যমে উৎপাদন করে। মানুষ এসব করে নিজ প্রয়োজনে, নিজের জন্য। বৃক্ষরোপণ ও চাষাবাদের মাধ্যমে মানুষ যে সৃষ্টির সেরা, তা প্রমাণিত হয়ে যায়।

আমরা অনেকেই কৃষিকাজকে তুচ্ছ মনে করি। ছোট বলে ঘৃণা করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজই ছোট নয়। সৎভাবে করা সকল কাজই উত্তম। বৃক্ষরোপণেও কোনো লজ্জা নেই; বরং এটি অনেক সাওয়াবের কাজ।

বৃক্ষরোপণ বা ফসল ফলানো এমন একটি কাজ যা দ্বারা শুধু মানুষই নয় পশুপাখি এবং অন্যান্য প্রাণিও উপকৃত হয়। এ জন্য মহানবি (সা.) বৃক্ষরোপণ ও ফসল ফলানোকে সাদকাহ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

শিক্ষা 

১. মহানবি (সা.) আমাদেরকে বৃক্ষরোপণের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। 

২. সৃষ্ট জীবের উপকারের প্রত্যাশায় বৃক্ষরোপণ ও চাষাবাদ করা সাদকায়ে জারিয়া। যতদিন এগুলো বেঁচে থাকবে, ততদিন ব্যক্তির আমলনামায় সাওয়াব লিপিবদ্ধ হতে থাকবে। 

৩. বৃক্ষরোপণ দ্বারা মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হয়। পরিবেশ সংরক্ষিত থাকে। পাশাপাশি আখিরাতেও প্রতিদান পাওয়া যায়। এ জন্য প্রত্যেকের উচিত বীজ বপন ও বৃক্ষরোপণ করে পরিচর্যা করা। 

৪. বৃক্ষরোপণ ও চাষাবাদ করা নবির সুন্নাত। 

৫. মানুষের উৎপাদিত ফল-ফসলে পশু-পাখি এবং অন্যদেরও অধিকার রয়েছে। 

৬. পরিবেশ ও মানুষের জন্য ঔষধি বৃক্ষ বা ফলবান বৃক্ষ খুবই উপকারি। 

৭. মু'মিনের কোনো তৎপরতাই বৃথা যায় না। 

৮. অপরের উপকার করাই ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

 

হাদিস-৩: (কাজের শুরুতে সংকল্প বা নিয়তের গুরুত্ব সম্পর্কিত হাদিস)

إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ

অর্থ: প্রকৃতপক্ষে সকল কাজ (এর ফলাফল) নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। (বুখারি)

 ব্যাখ্যা 

ইসলামে বিশুদ্ধ নিয়তের গুরুত্ব অনেক বেশি। সালাত, সাওম থেকে শুরু করে সবকিছুতেই নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া জরুরি। নিয়তের বিশুদ্ধতা না থাকলে ভালো কাজও মূল্যহীন। আল্লাহর কাছে সেই কাজ গ্রহণযোগ্য হবে না। নিয়তে গরমিল থাকার কারণে ভালো কাজ করেও জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে হবে।এই হাদিসটি সহিহ বুখারির সর্বপ্রথম হাদিস। এর তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক। মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যা করে, সব কিছুই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। এ হাদিস দ্বারা কাজের উদ্দেশ্যের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে। নিয়ত আরবি শব্দ। নিয়ত হচ্ছে মনের ঐকান্তিক ইচ্ছা বা সংকল্প। শরি'আতের পরিভাষায় খাঁটি নিয়ত হলো একনিষ্ঠতার সঙ্গে শুধু মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করা।

পরকালে মানুষের সকল কৃতকর্মের হিসাব হবে। সেদিন কে কোন নিয়তে কাজ করেছে, তার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হবে। মানুষ সৎ উদ্দেশ্যে কাজ করলে পুরস্কার পাবে। নেক নিয়তে কাজ করে ব্যর্থ হলেও পুরস্কার পাবে। আর মন্দ উদ্দেশ্যে কাজ করলে শাস্তি পাবে। যেমন যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সমাজসেবা করে, তাদের সমাজসেবাও হবে, আবার তারা আল্লাহর নিকট প্রতিদানও পাবে। আবার যারা লোক দেখানোর নিয়তে সমাজসেবা করে, তাদের শুধু সমাজসেবাই হবে। তারা আল্লাহর নিকট কোনো প্রতিদান পাবে না। কারণ, আল্লাহ তা'আলা মানুষের চেহারার দিকে না তাকিয়ে অন্তর দেখবেন। নিয়ত সঠিক না হলে ভালো কাজও মন্দ হিসেবে পরিগণিত হবে। লোক দেখানো কাজকে ইসলামের পরিভাষায় রিয়া বলে। রিয়া সম্পর্কে কঠিন শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশেষ এক প্রেক্ষাপটে এ হাদিসটি বর্ণনা করেন। আর তা হলো- উম্মে কায়স নামের একজন নারী ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় হিজরত করেন। তখন জনৈক ব্যক্তি তাঁকে বিয়ে করার জন্য মদিনায় হিজরত করে। ঐ ব্যক্তির উদ্দেশ্য জানতে পেরে রাসুলুল্লাহ (সা.) এ হাদিসটি বর্ণনা করেন। যার মূল বক্তব্য হলো- আল্লাহ তা'আলার সন্তষ্টির জন্য হিজরত করা অত্যন্ত পুণ্যময় কাজ। আল্লাহর সন্তষ্টির নিয়ত না থাকায় লোকটি হিজরতের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হলো।

সুতরাং আমরা বিশুদ্ধ নিয়তে সকল কাজ করব। লোক দেখানো বা দুনিয়াবি লাভের আশায় কোনো কাজ করব না; বরং আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসুলের সন্তষ্টির জন্য কাজ করব।

 

শিক্ষা

১. আমাদের প্রতিটি কাজে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। 

২. কর্মফল নিয়তের উপরই নির্ভশীল। নিয়ত ভালো হলে উত্তম প্রতিদান পাবে। আর নিয়ত খারাপ হলে ভালো কাজ করেও সাওয়াব পাবে না। 

৩. আল্লাহ তা'আলা মানুষের বাহ্যিক আমলের সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের অবস্থাও লক্ষ করেন। 

৪. প্রচারণামূলক লোক দেখানো ইবাদাত বা কাজ পরিহার করা উচিত। 

৫. মৃত্যুর পর সব কাজেরই হিসাব হবে। 

৬. নিয়ত খারাপ হলে ভালো কাজ করেও পরকালে শাস্তি পেতে হবে।

 

হাদিস-৪ (রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসা সম্পর্কিত হাদিস

لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ

অর্থ: তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মু'মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয়পাত্র হব। (বুখারি)

ব্যাখ্যা 

এ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব নির্দেশ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকৃত মু'মিন হওয়ার শর্ত। নবি (সা.)- এর প্রতি ভালোবাসা ছাড়া তাঁর আদর্শ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ছাড়া তাঁর আদর্শ সমাজে বাস্তবায়ন অসম্ভব।

ইমানের দাবি হলো, সর্বক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতকেই প্রাধান্য দেওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণে নিজের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দেওয়া। এভাবে নবি (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা।

অতএব মু'মিনদেরকে সকল ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে। বলতে হবে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসি। কেননা, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা এবং আনুগত্য।

শিক্ষা 

১. প্রকৃত ইমানের দাবি হলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা। 

২. রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে হবে। ৩. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন সম্ভব নয়। 

৪. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা হলো সমাজ জীবনে তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ বাস্তবায়ন করা। 

৫. মহানবি (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা হবে আকিদা, বিশ্বাস, জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকজনিত। 

৬. ইসলামি আদর্শ ও বিশ্বাসের পরিপন্থী সকল প্রিয়জনকে উপেক্ষা করে মহানবি (সা.)- কে ভালোবাসতে হবে।

হাদিস- ৫ (মু'মিনের ওপর অপর মু'মিনের দায়িত্ব সম্পর্কিত হাদিস)

لِلْمُؤْمِنِ عَلَى الْمُؤْمِنِ سِتُّ خِصَالٍ يَعُودُهُ إِذَا مَرِضَ وَيَشْهَدُهُ إِذَا مَاتَ وَيُجِيبُهُ إِذَا دَعَاهُ وَيُسَلِّمُ عَلَيْهِ إِذَا لَقِيَهُ وَيُشَمِّتُهُ إِذَا عَطَسَ وَيَنْصَحُ لَهُ إِذَا غَابَ أَوْ شَهِدَ

অর্থ : এক মু'মিনের ওপর আরেক মু'মিনের ছয়টি হক রয়েছে। সে অসুস্থ হলে তাকে সেবা করবে, মারা গেলে তার জানাযায় উপস্থিত হবে, তাকে ডাক দিলে সে সাড়া দেবে, তার সঙ্গে দেখা হলে তাকে সালাম দেবে, সে হাঁচি দিলে তার জবাব দেবে এবং তার উপস্থিতি-অনুপস্থিতি সব সময় তার কল্যাণ কামনা করবে। (তিরমিযি)

ব্যাখ্যা 

ইসলামে রয়েছে অধিকার ও কর্তব্যের সুন্দর সমন্বয়। সবাইকে দেওয়া হয়েছে তার প্রাপ্য অধিকার। ইসলামে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অন্যের হকের ওপর। আর মু'মিনরা পরস্পর ভাই ভাই। এক মুসলমান ভাইয়ের ওপর অন্য মুসলমান ভাইয়ের ছয়টি হক রয়েছে। হকগুলো হলো:

একজন মু'মিন অসুস্থ হলে তার খোঁজখবর নেওয়া, সেবা-শুশ্রুষা করা, তাকে আর্থিক ও শারীরিকভাবে সহযোগিতা করা, তার সুস্থতার জন্য দোয়া করা ইত্যাদি অন্য মু'মিনের নৈতিক দায়িত্ব। এটি আত্মীয়, অনাত্মীয়, ধনী-গরিব, পরিচিত-অপরিচিত সকল মু'মিনের জন্য। কেননা, রোগীর সেবা করার মাঝেই আল্লাহর সেবা নিহিত।

এছাড়া কোনো মু'মিন মারা গেলে তার জানাযায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এটা শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়; বরং তা ঈমানের অঙ্গও বটে। জানাযায় অংশগ্রহণ ও দাফন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ কাজ।

মু'মিনের ডাকে যথাসাধ্য সাড়া দিতে হবে। বিশেষ করে একজন মু'মিন যখন কোনো ভালো কাজে ডাকবে, অথবা কোনো বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ডাকবে, অথবা খাওয়ানোর জন্য ডাকবে, তখন তার ডাকে সাড়া দেওয়া অন্য মু'মিনের কর্তব্য।

ইসলামে আদব বা সামাজিক শিষ্টাচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর অন্যতম হলো সালাম বিনিময় করা। সালাম আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য সম্ভাষণ। তিনি জান্নাতিদের লক্ষ করে সালাম দেবেন। সালাম অত্যন্ত সহজ ও অন্যের জন্য কল্যাণ কামনামূলক একটি সম্ভাষণ। কারো ঘরে প্রবেশের পূর্বে, মজলিসে আগমন করলে উপস্থিত লোকদের, ছোট-বড়, ধনী-গরিব সবাইকে সালাম দিতে হবে। তাছাড়া যে আগে সালাম দেবে সেই আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।

কোনো মু'মিন যদি হাঁচি দিয়ে 'আলহামদুলিল্লাহ' (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর) বলে, তাহলে শ্রোতা তার উত্তরে 'ইয়ারহামুকাল্লাহ' (আল্লাহ তোমার উপর অনুগ্রহ করুক) বলবে। এ উত্তর শোনার পর হাঁচি দাতা 'ইয়াহদিকুমুল্লাহু' (আল্লাহ তোমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন) বলবে। হাঁচিদাতা হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ না বললে জবাব দেওয়া লাগবে না। হাঁচির আদব হলো, হাঁচি দেওয়ার সময় হাত অথবা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা এবং যথাসম্ভব শব্দ কম করা।

মু'মিনের উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে তার কল্যাণ কামনা করতে হবে। অনুপস্থিতিতে কল্যাণ কামনার অর্থ হলো, তার অনুপস্থিতিতে তার সম্পদ নষ্ট না করা এবং নষ্ট হতে দেখলে তা হেফাজত করা। উপস্থিতিতে কল্যাণ কামনার অর্থ হলো, তাকে সর্বাবস্থায় সহযোগিতা করা, তার প্রতি যুলুম না করা, তাকে যুলুম করতে না দেওয়া, তাকে ধোঁকা না দেওয়া, ধোঁকায় পড়ার আশংকা থাকলে তাকে সচেতন করা, তার সঙ্গে বিভেদ না করা ইত্যাদি।

এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের আরো কিছু দায়িত্ব হলো, তাকে সাহায্য করা, তার দোষ গোপন রাখা, তার ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করা, তার সম্পর্কে মনে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ পুষে না রাখা ইত্যাদি।

সুতরাং প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তিকে বিষয়গুলো লক্ষ রাখা উচিত। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সবাইকে অপর মুসলিম ভাইয়ের হকগুলোকে যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন।

 

শিক্ষা 

১. অসুস্থতার সময় একজন মু'মিন অপর মু'মিনের পাশে থেকে সেবা ও সহায়তা করবে। 

২. মু'মিনের জানাযায় অংশগ্রহণ করবে। তার পরিবার-পরিজনকে সান্ত্বনা দেবে। তার দাফনের কাজ শেষ করবে। 

৩. বিপদে-আপদে সর্বাবস্থায় তার দাওয়াতে সাড়া দেবে। 

৪. পরিচিত অপরিচিত সকল মু'মিনের মাঝে সালামের প্রচলন করবে। 

৫. হাঁচি দেওয়ার পর তার জন্য দোয়া করবে। 

৬. মু'মিনের ক্ষতি হয় এমন কাজ করবে না; বরং সার্বিকভাবে তার কল্যাণ কামনা করবে।

 

হাদিস-৬ (মৃত্যু পরবর্তী আমল সম্পর্কিত হাদিস)

إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ : إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ

অর্থ: যখন কোনো লোক মারা যায়, তখন তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। তিন প্রকার আমল ব্যতীত। সাদকাহ জারিয়া (চলমান দান); ঐ ইলম, যা দ্বারা অন্য লোক উপকৃত হয়; আর নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম)

ব্যাখ্যা 

পৃথিবীতে মানুষের সব কর্মতৎপরতা সংরক্ষণ করা হয়। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এসব কর্মতৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। প্রিয় নবি (সা.) আলোচ্য হাদিসে এ তিনটি আমলের কথা উল্লেখ করেছেন। আমল তিনটি হলো

এমন দান, যাতে মানুষ ও প্রাণিজগৎ সর্বদা উপকৃত হয়। এ দানের সাওয়াব চলমান। যেমন: মসজিদ, মাদ্রাসা, ইয়াতিমখানা, সরাইখানা, হাসপাতাল, পুল নির্মাণ, গাছ লাগানো, দীর্ঘস্থায়ী অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজ ইত্যাদি।

এমন জ্ঞান, যাতে মানুষ উপকৃত হয়। যেমন: ইসলামি ও জনকল্যাণমূলক বই-পুস্তক রচনা করা, জনকল্যাণমুখী আবিষ্কার, আদর্শ ও শ্রেষ্ঠ ছাত্র তৈরি করে যাওয়া, যারা অন্যদের জ্ঞান বিতরণ করতে থাকবে, এমন আদর্শ রেখে যাওয়া যা চিরকাল মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকবে ইত্যাদি।

অনুরূপ সুশিক্ষিত ও আদর্শ সন্তান রেখে গেলে সন্তানের সৎকর্ম দ্বারা মাতা-পিতা উপকৃত হতে থাকবে। সন্তান যত দিন নেক কাজ করবে, মাতা-পিতা ততদিন তা থেকে সাওয়াব পেতে থাকবে। সন্তান মাতা-পিতার জন্য দোয়া করতে থাকবে। নেক সন্তান বলবে, হে আল্লাহ মাতা-পিতা আমার প্রতি দয়া ও সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন, আমার শৈশবকালে আদর-যত্ন দিয়ে লালন-পালন করেছিলেন, তুমি তাঁদের প্রতি অনুরূপ দয়া ও অনুগ্রহ করো।

অতএব যারা চলমান জনকল্যাণমূলক কাজ করবে, উপকারী জ্ঞান ও নেক সন্তান রেখে যাবে, তারা মৃত্যুর পরও সাওয়াব পেতে থাকবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের এ ধরনের কাজ করার তাওফিক দান করুন।

 

শিক্ষা 

১. মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আমলের পথ বন্ধ হয়ে যায়। শুধু সাদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান ও নেক সন্তান মানুষের জন্য সাওয়াব পাঠাতে পারে। 

২. সাধারণ দানের পাশাপাশি সাদকায়ে জারিয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কল্যাণমূলক কাজ হলো সর্বোত্তম ইবাদাত। 

৩. আমাদের যথাসম্ভব স্থায়ী কল্যাণমূলক ও সংস্কারমূলক কাজে অর্থ ও মেধা ব্যয় করা উচিত। তাহলে মৃত্যুর পরও ভালো কাজে অংশগ্রহণের ধারা অব্যাহত থাকবে। 

৪. মাতা-পিতার দায়িত্ব হলো সন্তানকে সৎ ও আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। সন্তানের কর্তব্য হলো মাতা-পিতার আনুগত্য করা। মাতা-পিতার মৃত্যুর পর তাঁদের জন্য দোয়া করা। 

৫. মু'মিনের সকল কাজের মূল লক্ষ্য হবে আখিরাতের সফলতা।

 

প্রতিফলন ডায়েরি লিখন 

'কুরআন-হাদিসের যে শিক্ষায় আমার জীবন আলোকিত করব' 

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে কুরআন-হাদিসের শিক্ষা তোমার বাস্তব জীবন কীভাবে আলোকিত বা উদ্ভাসিত করবে ৩০০ শব্দের মধ্যে লিখে আনবে।)

 

Content added By
Promotion